বিশ্বসেরা মুসলমান দার্শনিক উপমহাদেশে ইংরেজি পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক হজরত ডিপুটি শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম(রহঃ) ভারতীয় সভ্যতার স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বীর সৈনিক এ চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান। তাদের মধ্যে অন্যতম ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হলেন হজরত ডিপুটি শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহঃ)।বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী যখন অত্যাচার- নির্যাতন বাড়িয়ে মানুষকে পশুর মতো ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়েছে তখনই আমাদের কৃতী পুরুষগণ আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠেছে। প্রতিবাদের অপরাধে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে। চাকরিচ্যুতি কোন ব্যাপার নয়। বৃটিশদের দাবানলের সামনে প্রকাশ্য কলম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া মহানায়ক হলেন- ডিপুটি শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম, মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুর রশিদ সিদ্দিকী, কাজেম আলী মাস্টার, হাকিম আলতাফুর রহমান (গান্ধীজী), ছৈয়দ মৌলভী সোলতান, মাওলানা আবদুল হাই, সীতাকুন্ডের বড় মাওলানা প্রমুখ মনীষীগণ সরাসরি কলম যুদ্ধে লিপ্ত হন। বীর মাস্টারদা সূর্যসেন ও তাঁর সৈন্য সেনারা সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভারতীয় স্বাধীনতায় আরো যারা অতি গুরুত্ব সহকারে বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তারা হলেন- মাওলানা ইসমাইল শহীদ, মওলভী আবদুল হাই, গাজী মাওলানা রশিদ আহমদ, গাজী মাওলানা ফজলুল হক, মাওলানা আহমদুল্লাহ্, চট্টগ্রামের গাজী মওলানা শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ নিজামপুরী, মাওলানা গাজী শরিয়ত উল্লাহ্, মাওলানা বরকত উল্লাহ্, মাওলানা ইমামুদ্দিন, মাওলানা মাহমুদুল হাছান, মাওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ, মাওলানা বরকত উল্লাহ্, মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ প্রভৃতি আলেমগণ মহান স্বাধীনতার দাবি নিয়ে দেশ হতে দেশান্তরে হিজরত করেন। বহু আলেম সমাজের প্রতিনিধির ফাঁসি হয়, অনেকের মানবহীন দ্বীপে যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত হয়। অবশ্যই আজ আমরা সেই ইতিহাস ভুলতে বসেছি। আমাদের চিন্তা চেতনার নায়ক শাহ্ মুহাম্মদ বদিউল আলম বৃটিশদের সেই লীলাখেলা থেকে মুক্তির জন্য কলমের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি ইংরেজি পত্রিকা দি মোহামেডান অবজারভার পত্রিকায় তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সেই জন্য পত্রিকা বন্ধ ও সম্পাদক শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলমকে জেলে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৪ মহরম, ১ জুন ২০২৩ চট্টগ্রামের কৃতী বীর সন্তান ও মুসলিম মনিষীদের উদ্ভাসীত ডিপুটি শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলমের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষে শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম প্রণীত আমার পীর (১ম ভাগ) থেকে তাঁর জীবনীর অংশ বিশেষ এ প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করা হল।
১৮৫৬ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জাফর আলী হিল (বর্তমানে ডিসি হিল, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম-এর সরকারি বাসভবন) এর বাংলোয় তৎকালীন সরকারি উকিল ও স্বনামধন্য জমিদার মরহুম জাফর আলী খান সাহেবের এক পৌত্র জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ হযরত শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহঃ) ওরফে জোলফুক্কার শাহ্ জাঁহাগীরি প্রকাশ শাহ্ সাহেব।
হযরত শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহঃ) এর পিতা খান বাহাদুর মৌলানা আনওয়ার আলী খান তৎকালীন একমাত্র মুসলিম সাব জজ ও সদর আমিন যার পূণ্যকীর্তি বহন করে আছে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার কালীপুর গ্রামে অবস্থিত ‘সদর জামে মসজিদ’, ‘সদর আমিন হাট’ ও ‘সদর আমিন খাল’। তাঁর চাচা মৌলানা মোহাম্মদ করিমদাদ খান ছিলেন বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, যার কাছে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি স্কুল , যা চট্টগ্রাম কলেজের ঐ জাইগায় ছিল পরে কলেজ স্থাপন হলে তা শরীয়ে বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল আইসফ্যাক্টি রোড ও কলিকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ালেখা করেন পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেজুয়েশন সম্পুর্ণ করেন।শিক্ষা জীবন শেষে তিনি ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নোয়াখালীর খাসমহালে যোগদান করেন।(১৮৮৩-১৮৯২) চাকরিকালে কালেক্টর সাহেব এর মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও বৃটিশবিরোধী মনোভাব দেখে তখনকার চট্টগ্রামের কমিশনার মি. লয়েল এর যোগসাজশে তাঁকে চাকুরিচ্যুত করেন। এক বছরকাল তিনি এই অবস্থায় ছিলেন। তিনি কমিশনার ও কালেক্টরের বিরুদ্ধে তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে এর বিহিত চেয়ে আবেদন করেন। অবশেষে সত্য ও ন্যায়ের জয় হলো। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নির্দেশে তিনি আবার সসম্মানে স্বীয় পদে পুনর্বহাল হলেন।
১৮৯১ ইংরেজি সনের মে মাসের ১৬ তারিখে আমার মোকদ্দমা গভর্নমেন্ট নিত্তি করেন এবং তখনকার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সার স্টুওয়ার্ট বেলী এক সুদীর্ঘ রায় প্রকাশ করিয়া তাকে চাকরিতে বহাল করেন। সেই রায় হতে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করলাম-
“Sir Stuart Bayley regrets that Mr. Lyall in going to express his disapproval of the suggestion made by Government regarding Moulavi Badiul Alam should have betrayed himself into inaccuracies and overstatements pointed out by the Board. Personal explanation is necessary. Under these circumstances Moulavi Badiul Alam is reinstated.”
ডিপুটি শাহ্ সাহেব বিখ্যাত আমার পীর নামক গ্রন্থের এক স্থানে তিনি লিখেন, ‘‘১৮৯১ সনের জুলাই মাসে চাকরিতে হাজির হলাম, নোয়াখালীর খাস-মহলের ডেপুটি কালেক্টরের চেয়ারে আবার বসলাম। আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। চেয়ারে বসলাম বটে, কিন্তু অন্তরে দৃঢ় সংকল্প করলাম ইংরেজের গোলামী আর করব না।’’
এ সময় সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল। ভারতীয় কংগ্রেস রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। অসহযোগ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। তেজস্বী বদিউল আলমের ইংরেজ বিরোধী মনোভাব আরো দৃঢ় হলো। ১৮৯২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতা সাব জজ খান বাহাদুর মাওলানা আনওয়ার আলী খান হঠাৎ ইহলোক ত্যাগ করেন। এ সুযোগে তিনি ১৩ চাকরিতে ইস্তফা দেন। কবি নবীন চন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর সহকর্মী। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ও হৃদয়ের নিবিড়তা ছিল অপরিসীম। তিনি শাহ্ সাহেবকে চাকরিত্যাগে বাধা দিলেন, কিন্তু রাখতে পারলেন না। স্বাধীনতার নেশায় তিনি সরকারি দফতর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন দেশমাতৃকার ডাকে। কবি নবীন চন্দ্র সেন তাকে পাগলা বলে সম্বোধন করতেন।
বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি নবীন চন্দ্র সেন, তার পিতার বাবজানের ইন্তিকালের সংবাদ পেয়ে তার নিকট লিখেয়াছিলেন-
“My dear Pagla, You should thank God that your Rev. Father has joined his Creator in the fulness of Time, completing a successful career, relieved of a life which has no more any charm for him.’’
চাকরি ত্যাগ করে তিনি তখনকার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পীঠস্থান ও বঙ্গদেশের রাজধানী কলিকাতায় চলে আসেন। কলিকাতায় তিনি নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার মুসলমানদের প্রথম ও একমাত্র ইংরেজি মুখপত্র ‘‘দৈনিক মোহামেডান অবজারভার’’ নামক পত্রিকার দায়িত্ব ও সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। বেশ কয়েক বছর তার লেখনী ও ক্ষুরধার বলিষ্ঠ সম্পাদকীয়তে দেশ ও জাতির বিভিন্ন সমস্যা ইংরেজ শাসকদের কাছে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে, তেমনি জাতি প্রাণ প্রবাহের নবতর স্পন্দনে জীবনের সন্ধান লাভ করে। এই পত্রিকার ইংরেজ বিরোধী ও জাতীয়তাবাদী মননশীল লেখনী ইংরেজদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের রোষানলে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন এবং জীবিকার তাগিদে কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি এই কৃষি কাজ সম্পর্কে বলেন, ‘‘১৮৯৫ সনের ফেব্রুয়ারি হতে ১৮৯৬ সনের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই ১ বছর ৮ মাস কাল আমার কৃষক জীবনই আমার জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় বলে আমি স্বীকার করতে বাধ্য।’’
কথিত আছে, কমিশনার সাহেব এ সময় বাঁশখালী থানা পরিদর্শনে গেলে, তিনি তাঁর গ্রামের জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে দেখানোর জন্য কমিশনার সাহেবকে নিজ বাড়ি নিয়ে গিয়ে চাটাই বিছিয়ে দেন এবং কমিশনার সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “The is village carpet, we sit, sleep and lie on this.” অগত্যা কমিশনার সাহেব বসে পড়লেন। তারপর এলো ভাঁপা পিঠা (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ধুয়া পিঠা) ও খেজুরের রস মাটির পাত্রে করে তাকে আপ্যায়নের জন্য। কমিশনার সাহেবের আবার বিব্রত প্রশ্ন, “What is this?” শাহ সাহেবের নির্বিকার উত্তর “This is village cake, our home made and this is date-tree juice, a very popular and delicious combination for winter refreshment.” শেষ পর্যন্ত কমিশনার সাহেব অতি আগ্রহ সহকারে সে পিঠা ও রস খেয়ে শাহ সাহেবকে সাথে নিয়ে যান বাঁশখালী থানা সদর দফতরে। সেখানে তাঁর জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল বিরাট সংবর্ধনা ও জনসমাবেশের। সেই সমাবেশে স্থানীয় সমস্যার ওপর বদিউল আলম সাহেব বাংলা, উর্দু, ফার্সী ও ইংরেজি অনুবাদসহ যে বক্তৃতা করেন তা আজও কিংবদন্তীর মতো বর্তমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, ফারসি ও আরবী ভাষায়ও সুপন্ডিত ছিলেন।
তিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, বৃটিশবিরোধী আইন অমান্য আন্দোলন ইত্যাদিতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অদম্য ভূমিকায় আতঙ্কিত হয়ে বৃটিশশাসক তাঁকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করে। এক বছরের অধিককাল তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন।
এ সময়ের পরে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাহবুবে ছোবহানী, গাউছে ছামদানী কুতুবে রাববানী, গাউছুল আজম হযরত মহিউদ্দিন সৈয়দ শেখ আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এর তরিকার ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম জেলার মির্জাখীল দরবার শরিফের ১ম শাহ জাহাঁগীর হজরত শেখুল আরেফীন (কঃ)সৈয়্যদুনা মাওলানা মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান (কঃ) এর সুযোগ্য গদীনশীন সন্তান ২য় শাহ জাহাঁগীর হযরত ফখরুল আরেফীন সৈয়্যদুনা ওয়া মৌলানা মোহাম্মদ আব্দুল হাই (কঃ) এর আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব ও খেলাফত গ্রহণ করেন। তিনি ভূষিত হলেন হযরত মৌলানা শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহঃ) ওরফে জোলফক্কার শাহ প্রকাশ শাহ সাহেব নামে। এ সময় ইংরেজ সরকার তাঁকে খাঁন বাহাদুর উপাধি দানে সন্তুষ্ট করতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জনগণের দেয়া শাহ্ খেতাবই মাথা পেতে নেন।
হায়দ্রাবাদের নিজাম ও ভুপালের রাণীর দরবারে ছিল তাঁর অবাধ গতি। তিনি তাঁদের অর্থানুকূল্যে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘‘ইজ্জতনগর হাই স্কুল”। তাঁর স্কুলে ইংরেজি ও ধর্মীয় শিক্ষা দুটোই ছিল বাধ্যতামূলক। রোববারের পরিবর্তে শুক্রবার ও সকল ধর্মীয় উৎসবের দিনে স্কুলটি বন্ধ থাকত। স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ধর্মীয় মতাদর্শে স্কুল পরিচালনা করতেন। এতে বৃটিশদের স্থানীয় দোসরদের গভীর চক্রান্তে বাঁশখালী থানার প্রথম উচ্চবিদ্যালয়টি সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেলে শাহ্ সাহেব আঘাত পেলেন। মর্মাহত হলেন। তিনি লেখনীর মাধ্যমে তার কর্মকান্ড পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মনুষ্যত্ব, ধর্ম, রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন ও বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ করেন। তাঁর প্রায় সব অর্থের অভাবে প্রকাশ করা সম্ভবপর হয়নি যার পান্ডুলিপিও পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যায়। তার অসংখ্য পান্ডুলিপির মধ্যে মাত্র কয়েকটি বই আকারে বের হয়। তার মধ্যে- ১। The Universal Religion of Man in the Light of Islam and What is Man Vol I & II (Vol II এর কোন কপি পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়নি) ২। ফতুহুল গয়ব, ৩। আদাবে মুরীদ, আদাবে তরীকত ও জাহাঙ্গীরি দর্পণ, ৪। আইনায়ে জাহাগীরি, ৫। আজকার ও আশগাল, ৬। আমার পীর ও ৭। ওয়াহাবী বিভ্রাট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হোয়াটইজ ম্যান বইটি আমেরিকার বিখ্যাত পাবলিকেশন কেসিঞ্জার প্রকাশনী থেকে প্রিন্ট হচ্ছে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ও লন্ডন আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়চ্ছে।
তিনি ইসলাম ও মনুষ্যত্বের বাণী পৌঁছানোর জন্য সিংহল, বার্মা, ভারতসহ উপমহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। এ সব জায়গায় তাঁর অনেক শিষ্য ছিল।
ডিপুটি শাহ সাহেবর একটা ঐতিহাসিক চিঠির উত্তরে লিখা আছে :-
কিশোরগঞ্জের পত্রের উত্তর, ২৩/০৩/১৯১৭ইং
“সমগ্র আরব দেশ,ভারত ও বার্মাতে খোদার ফজলে আমার দেরলক্ষ মুরিদান তথ ভিন্ন আমার পীর মুর্শিদের দশলক্ষ মুরিদান তাও এই অধমের তথ্যবধানে আছে আমি আর মুরিদ কি করিব আমার মতন অধমের জন্য এই কার্যকেত্রই যথেষ্ট।”
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই দীর্ঘাঙ্গী সবল ও সক্রিয় পুরুষটি গেরুয়া রংয়ের কাপড় ও চাঁনটুপি পরিহিত অবস্থায় সব সময় সকল ধর্মের ভক্ত, অনুরক্ত ও শিষ্য পরিবৃত হয়ে থাকতেন। দিনের পর দিন হুজুরা শরিফে ঢুকে আল্লাহর কাছে অঝোর নয়নে ফরিয়াদ করতেন। তিনি দুই বার পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।
হজরত ডিপুটি শাহ মুহাম্মদ বদিউল আলম(রহঃ) স্বম্মাননাগুলা পেয়েছেন :-
১।অল ইন্ডিয়া মুসলমান এসোসিয়েশন কলকাতা ভারত শাখা কতৃক ২০১৮ স্বম্মাননা লাভ করেন ।
২।চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র থেকে অমর একুশে পদকে ভুষিত হন ২০২০
৩। ভারত বাংলাদেশ নেপাল ইতিহাস মঞ্চ কলকাতা, ভারত,শাখা থেকে ভারত গৌরব স্বম্মাননা ২০২২।
৪।বাংলার রেনেসাঁ ও লাব্বাইক মিশন কলকাতা, ভারত কতৃক মরণউত্তর স্বম্মাননা ২০২৪ শে ভুষিত হন।
কারামত-১
হজরত শাহ জালাল ইয়ামানী (রহঃ) এর মাজার শরীফের মুতয়াল্লীর নুরুদ্দীনের বয়াত।।
মোঃ নুরুদ্দীন হল মুতয়াল্লী হজরত শাহ্ জালাল (রহঃ) মাজার শরীফের। তিনি দীর্ঘ বছর যাবত হজরত শাহ জালাল ইয়ামনী(রহঃ) এর মাজার শরীফের মুতয়াল্লীর হিসাবে কাজ করে আসতেছিলেন।একদিন চিন্তা করলেন যে আমিত এত দিন গত হল মাজার শরীফের খেতমত করতেছি কোন দিন বাবা শাহ্ জালালের দেখাও পেলামনা আর মুরিদ হলাম না আমার বয়সত হয়েগেছে যে কোন সময় মালিকের ডাক আসতে পারে কি হবে উপায় আমার।এইরকম চিন্তা করতে করতে একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে হজরত শাহ্ জালাল শাহ্ (রহঃ) আসলেন বললেন নুরুদ্দীন আমি শাহ জালাল বাবা । উনার ডান হাতে একজনকে নিয়ে বললেন ইনি হল তোমার পীর দেখে রাখ।উনি দক্ষিণ দিক থেকে আসবে চিনে রাখ।যাকে দেখাইলেন তিনি হল ডেপ্যুটি শাহ্ মোহাম্মদ বদিউল আলম(রহঃ)। এর পর থেকে উনি খোজতে আছেন কখন আসবেন আমার পীর মুর্শিদ এই গঠনার ১০ বছর পর শাহ সাহেব সিলেট মাজার শরীফ জিয়ারত করতে গেলেন। শাহ্ সাহেবের জন্য সরকারী ভাবে রুম দিতেন কারণ উনি ডেপ্যুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। তখন নুরুদ্দীন খুব অসুস্থ তাকাই দুজন লোক দিল। ডিপুটি সাহেবর খেতমতে। লোক গুলা গিয়ে ডিপুটি সাহেবকে বললেন মোতয়াল্লী সাহেব অসুস্থ সকালে দেখে করবেন আপনার সাথে আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনার খেতমতে।রাতে সিলেট শহরের বড় বড় অফিসার রা সবাই দেখা করতে আসলেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর “ডিপুটি শাহ্ সাহেব কেবলা”(রহঃ) বললেন যে এখন আমি কিছু আমার তরীকতের কাজ করব যদি কারো ইচ্ছা হয় বসতে পারেন নাহয় চলেযেতে পারবেন।আর যারা বসবেন তারা অযু সহিত বসতে হবে এই বলে সবাইকে অযু করতে পাঠালেন সবাই অযু করে আসলেন তারপর দায়রা শরীফ (সেমা)আরম্ভ করলেন।এমন সময় ভিতরের রুমে হজরত শাহ্ জালাল শাহ্ (রহঃ) এসে নুরুদ্দীন কে বলতে লাগলেন যে নুরুদ্দীন তুই ঘুমা তোর পীর তোর ঘরে এসে চলে যাচ্ছে। এই কথা নুরুদ্দীন শুনাুর পর খুব হাল হল যে দুইজন লোক ধরে রাখতে পারতেছেনা।একজন লোক এসে ডিপুটি শাহ্ সাহেব কেবলাকে বললেন যে আমাদের মোতয়াল্লী সাহেবের অবস্তা খারাব। শুনে শাহ্ সাহেব কেবলা উনার একটা গামছা দিলেন বললেন যে এইটা উনার মুখের উপরে বুলায়ে দিবে। এইবলে খাদেম তাই করলে এবং নুরুদ্দীন সাহেব একটু পরে ঠান্ডা হলেন। ঠান্ডা হয়ে বললেন আমাকে মেহেমান খানাই নিয়ে যাও। তারা দুজনে ধরে নিয়ে আসলেন শাহ্ সাহেব কেবলা মুরুব্বী মানুষ দেখে দাঁড়ালেন নুরুদ্দীন সাহেব শাহ্ সাহেব কেবলাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাঁর কদমে পরে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন হুজুর আমাকে আপনি মুরিদ করান।ডিপুটি শাহ্ সাহেব কেবলা বললেন যে বাবা আমি এই খানে এসেছি শাহ্ জালাল বাবার থেকে ফয়েজ নিতে মুরিদ কি ভাবে করাই? তখন নুরুদ্দীন সাহেব বলেন যে এইটা আমার কথা না এইটা বাবা শাহ্ জালালের কথা আজ থেকে ১০ বছর আগে আমাকে বলেছিলেন।আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।এখনো আবার এসে বলে গেলেন যে আপনি আসছেন এইটা।তখন শাহ্ সাহেব কেবলা মোতয়াল্লী নুরুদ্দীন সাহেবকে মুরিদ করালেন। এই ঘঠনা দেখে ঐখানে অনেক শহরের গণ্যমাণ্য লোক মুরিদ হয়েছিলেন।
১লা জুন ১৯৩১ সাল, মোতাবেক ১৪ই মহরম১৩৫০ হিজরী রোজ সোমবার চট্টগ্রামে ইন্তিকাল করলে একটি কণ্ঠ নিস্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে। তাঁর বাড়ীর সামনে সুনীল দীঘির উত্তর পাড়ে মোগল কারুকার্যের আদলে সবুজ শ্যামলে ঘেরা প্রাকৃতিক অপরুপ সুন্দর পরিবেশে এই মাজার শরীফ অবস্থিত। তারই অব্যান্তরে শুয়ে আছেন জাতীর প্রেরণা হয়ে।যেন এইটা জান্নাতের বাগানে পরিনত হয়েছেএবং জিয়ারতে স্থান রুপে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসে জিয়ারতের উদ্দেশ্য। জিয়ারত করে প্রতি নিয়ত ফয়েজ প্রাপ্ত হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা এই অলী আল্লাহর উছিলায় আমাদেরকে তাঁর দেখানো সুপথে চলার তৌফিক দান করুন আমিন।তাঁর ওফাত দিবসে আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক:-মোহাম্মদ নাজমুল হক শামীম,
সম্পাদক/প্রকাশক :-লিটল ম্যাগাজিন চট্টলানামা।
সাধরণ সম্পাদক , বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা
Leave a Reply